মালচিং পদ্ধতিতে মরিচ চাষ
পেইজ সূচিপত্র
- মালচিং পদ্ধতিতে মরিচ চাষের সুবিধা সমূহ মালচিং পদ্ধতিতে মরিচ চাষ করলে যে সকল সুবিধা পাওয়া যায়
- মালচিং পদ্ধতিতে মরিচ চাষে জমি প্রস্তুতি করণ
- মালচিং পদ্ধতিতে মরিচ চাষের উপকরণ নির্বাচন
- মালচিং পদ্ধতিতে মরিচের চারা রোপণ
- মালচিং পদ্ধতিতে মরিচ গাছের চারার পরিচর্যা
- মালচিং পদ্ধতিতে মরিচ সংগ্রহ
- শেষ কথা
মালচিং পদ্ধতিতে মরিচ চাষের সুবিধা সমূহ
মালচিং পদ্ধতি হলো একটি আধুনিক কৃষি পদ্ধতি, যা মাটির আদ্রতা বজায় রাখে,আগাছা নিয়ন্ত্রণ এবং ফলনের পরিমাণ ও গুণগত মান উন্নত করতে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশের মরিচ চাষে মালচিং পদ্ধতির ব্যবহার ক্রোমাগত জনপ্রিয় হচ্ছে এই পদ্ধতিতে পলিথিনের পাতলা সিট বা অন্যান্য আচ্ছাদন ব্যবহারের মাধ্যমে জমি ঢেকে দেয়া হযএ,যা মরিচ চাষের জন্য বিশেষ উপকারী।
মালচিং পদ্ধতিতে মরিচ চাষ করলে যে সকল সুবিধা পাওয়া যায়
মালচিং পেপার ব্যবহার করে কাঁচা মরিচ চাষ করা বেশ কিছু উপকারিতা রয়েছে। চলুন এই উপকারিতা গুলো জেনে নিই।
- এই পদ্ধতিতে একবারে বেশি খরচ হলেও তার পরে আর কোনো খরচ নেই।
- জমির শেষ চাষের সময় একেবারে সব সার দিয়ে গাছ লাগাতে হবে।
- চারা রোপন করার পরে জমিতে আর কোনো সার প্রয়োজন হয় না।
- মালচিং পেপার এর কারণে বিভিন্ন পোকামাকড়ের আক্রমণ কম হয়।
- এই পদ্ধতিতে গাছের গোড়া ছাড়া পুরো বেড মালচিং পেপার দিয়ে ঢাকা থাকে ফলে কোনো প্রকারের আগাছা জন্মাতে পারেনা।ফলে আগাছা দমনের বাড়তি খরচ বেঁচে যায়।
মালচিং পদ্ধতিতে মরিচ চাষের করণীয় বিষয় সমূহ-
জমি প্রস্তুত করণ, মালচিং এর উপকরণ নির্বাচন, মালচিং এ পলিথিন বিছানো, মরিচের চারা রোপণ,সেচ ব্যবস্থাপনা, আগাছা নিয়ন্ত্রণ, রোগ ও পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ, ফসল সংগ্রহ সহ আরো বেশ কিছু বিষয় নিয়ে চলুন আলোচনা করি।
মালচিং পদ্ধতিতে মরিচ চাষে জমি প্রস্তুতি করণ
মালচিং পদ্ধতিতে মরিচ চাষের জন্য জমি প্রস্তুত করার ধাপগুলো বেশ গুরুত্বপূর্ণ কারণ সঠিকভাবে জমি প্রস্তুত করলে মাটির সুষম আদ্রতা ধরে রাখতে পারে চারা সহজে বসানো যায় এবং মালচিং এর কার্যকারিতা বাড়ে, নিচে জমি প্রস্তুতির ধাপ গুলো বিস্তারিত তুলে ধরা হলো।
- প্রথমে মাটি ভালো ভাবে চাষ দিতে হবে মাটি উর্বরতা এবং পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ২০-৩০ সেমি গভীরে চাষ করা উচিত।
- প্রথম চাষের পর মাটিতে বড় বড় মাটির ঢেলা ভেঙ্গে নেয়া প্রয়োজন। এটি মাটির গঠন উন্নত করতে সহায়ক।
- জমির মাটি থেকে আগাছা পাথর এবং অন্যান্য বাধা অপসারণ করতে হবে এগুলো না সড়ালে চারা রোপনে সমস্যা হতে পারে এবং আগাছা গাছের পুষ্টি গ্রহণ বাধা সৃষ্টি করতে পারে।
- জমিতে আগাছা নিয়ন্ত্রণে আগাম গ্লাইফোসেট জাতীয় আগাছা নাশক ব্যবহার করা যেতে পারে।
- মাটির উর্বরতা বাড়ানোর জন্য জমিতে জৈব সার যেমন ঃ গোবর,কমপোস্ট মেশানো প্রয়োজন। এটি মাটির জীব বৈচিত্র্য বাড়াই এবং পুষ্টি সরবরাহ সহায়ক।
- পাশাপাশি মাটির পরীক্ষার মাধ্যমে জমির জন্য প্রয়োজনীয় রাসায়নিক সার যেমন ইউরিয়া,টিএসপি এবং পটাশ দিতে হবে। সাধারণত প্রতি বিঘা জমিতে ৫০-৬০ কেজি,ইউরিয়া ৩০-৩৫ কেজি টিএসপি এবং ১৫-২০ কেজির পটাশ প্রয়োগ করা হয়।
- জমি ভালোভাবে সমান করতে হবে। এটি জমিতে সমানভাবে পানি প্রবাহ নিশ্চিত করে এবং সেচের সময় পানি জমতে দেয় না।
- জমি সমান হলে মালচিং পলিথিন বিছানো সহজ হয় এবং মরিচের চারা রোপণে সঠিকভাবে করা হয়।
- জমি প্রস্তুতির পর নির্দিষ্ট সাড়ি করে নিতে হবে। সাধারণত শাড়ির দ্রুত ৪০-৫০ সেমি রেখে সাড়ি তৈরি করতে হবে যাতে প্রতিটি সাড়িতে চারা রোপণ এবং রক্ষণাবেক্ষণ সহজ হয়।
- সাড়ির মাঝখানে মালচিং পলিথিন সিট ব্যবহার করার জায়গা তৈরি করতে হবে।এটি সঠিক ভাবে করতে পারলে মাটির আদ্রতা ধরে রাখতে এবং আগাছা নিয়ন্ত্রণে বিশেষভাবে সহায়ক হবে।
- জমির সাড়ি সমানভাবে তৈরি হওয়ার পর, কালো বা রুপালি রং এর মালচিং পলিথিন বিছিয়ে দিতে হবে।
- পলিথিনের সিট বিছানোর সময় নিশ্চিত করতে হবে।যেনো বাতাসের কারণে এটি সরে না যায় এজন্য প্রয়োজনীয় স্থানে মাটি দিয়ে পলিথিনের প্রান্ত গুলো চেপে দিতে হবে।
উপরোক্ত প্রক্রিয়াগুলো অনুসরণ করলে মালচিং পদ্ধতিতে মরিচ চাষের জন্য উপযুক্ত জমি প্রস্তুত হবে। এর ফলে মাটির আদ্রতা এবং পুষ্টি সংরক্ষণের সহায়তা করবে। পুষ্টি সংরক্ষণের সহায়তা করে,ফলে মরিচের গাছ দ্রুত বেড়ে ওঠে এবং ফলন বেশি হয়।
মালচিং পদ্ধতিতে মরিচ চাষের উপকরণ নির্বাচন
মালচিং পদ্ধতিতে মরিচ চাষের জন্য সঠিক উপকরণ নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ কারণ এর ওপর ফলন এবং চাষের সাফল্য অনেকাংশে নির্ভর করে। চলুন মরিচ চাষের জন্য মালচিং পদ্ধতির উপকরণ নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করা যাক।
- প্লাস্টিক শিট বিশেষ করে কালো সাদা বা রুপালি রংয়ের পলিথিন ব্যবহার করা উচিত। কারণ এটি সূর্যের আলো প্রতিফলন করে এবং তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
- এটি মাটির আদ্রতা দীর্ঘ সময় ধরে রাখতে সহায়ক এবং গাছের গোড়ায় সূর্যের আলো পৌঁছাতে না দেয়ায় আগাছার বৃদ্ধি সীমিত করে।
- প্লাস্টিকের মালচিং এর স্থায়িত্ব দীর্ঘ এবং এটি জৈব মালচিং এর তুলনায় আগাছা দমন এবং আদ্রতা ধরে রাখতে বেশি কার্যকরী।
পলিথিনের রং নির্বাচন
- কালো পলিথিন ঃ সূর্যের আলো প্রতিরোধ করে এবং গাছের গোড়ায় আলো প্রবেশে বাধা দেয়, যা আগাছা নিয়ন্ত্রণে বিশেষ কার্যকর।
- সাদা বা রুপালি পলিথিন ঃ সূর্যের আলোর প্রতিফলিত করে ফলে গরম মৌসুমে এটি তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়ক।রূপালী পলিথিন ব্যবহারে কিছু পোকামাকড়ের প্রাদুর্ভাব ও কমে।
- সাধারণত ২৫-৪০ মাইক্রন পুরুত্বের পলিথিন ব্যবহার করা হয়। এটি মাটির আদ্রতা ধরে রাখতে সহায়ক এবং টেকসই।
- পুরু পলিথিন বেশিদিন স্থায়ী হয় এবং ক্ষতির আশঙ্কা কম থাকে।পাতলা পলিথিন দ্রুত নষ্ট হতে পারে।
- মালচিং পলিথিনে মরিচের চারা রোপনের জন্য নির্দিষ্ট দূরত্বের ছিদ্র করতে হবে।
- সাধারণত ৪০-৫০ সেমি দূরত্বে ছিদ্র রাখতে হয় যাতে প্রতিটি গাছ পর্যাপ্ত স্থান পায় এবং সঠিকভাবে বেড়ে উঠতে পারে।
মালচিং পদ্ধতিতে মরিচের চারা রোপণ
মালচিং পদ্ধতিতে মরিচের চারা রোপণ একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে করা হয়, যাতে গাছ সঠিকভাবে বেড়ে উঠতে পারে এবং জমির আদ্রতা ও পুষ্টি ধরে রাখা যায়। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মাটির আদ্রতা সংরক্ষণ,আগাছা নিয়ন্ত্রণ এবং পোকামাকড় ও রোগের আক্রমণ থেকে চারা সুরক্ষা লাভ করে।নিচে মালচিং পদ্ধতিতে মরিচের চারা রোপনের ধাপ গুলো বিস্তারিত ভাবে তুলে ধরা হলো ঃ
- চারার রোপণের জন্য পলিথিনের নির্দিষ্ট দূরত্ব ছিদ্র করতে হবে।
- সাধারণত ছিদ্রের দূরত্ব ৪০-৫০ সেমি রাখা হয় এবং সাড়ি থেকে সাড়ির দূরত্ব ৬০-৭০ সেমি রাখা উচিত।
- ছিদ্রের আকার এমন হতে হবে যাতে চারা সহজে রোপণ করা যায় এবং পানি প্রবেশ করতে পারে।
- সাধারণত ২৫-৩০ দিন বয়সের চারা মালচিং পদ্ধতিতে রোপনের জন্য উপযুক্ত।এই বয়সে চারা যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং মাটির সাথে দ্রুত মানিয়ে নিতে পারে।
- চারা রোপনের আগে অবশ্যই চারার গোড়া ভিজিয়ে নিতে হবে, যদি তা সহজে রোপণ করা যায় এবং জমির আদ্রতা দ্রুত শোষণ করতে পারে।
- প্রতিটি ছিদ্রে একটি করে চারা রোপণ করতে হবে। রোপনের সময় নিশ্চিত করতে হবে যাতে চারার গোড়া পলিথিনের ছিদ্রের ভেতরে ঠিকমত বসানো থাকে।
-
চারার গোড়ায় হালকা মাটি চাপ দিয়ে বসিয়ে দিতে হবে, যাতে চারার গোড়া মাটির
সাথে দিরো ভাবে লেগে থাকে।
মালচিং পদ্ধতিতে মরিচ গাছের চারার পরিচর্যা
চারা রোপনের পর নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে বিশেষ করে প্রথম কয়েক সপ্তাহে কারণ এই সময় চারাগুলো সব চেয়ে স্পর্শকাতর হয়ে থাকে। আগাছা নিয়ন্ত্রণে জন্য বিশেষ কিছু না করলেও হবে কারণ মালচিং এর কারণে আগাছার প্রবেশের সুযোগ কম থাকে। পোকামাকড় ও রোগের আক্রমণ থেকে চারা রক্ষা করতে জৈব কীটনাশক বা রোগনাশক প্রয়োগ করা যেতে পারে। রুপালী রংয়ের মালচিং ব্যবহারে কিছু পোকামাকড়ের আক্রমণ কম হয়ে থাকে।
মালচিং পদ্ধতিতে মরিচ সংগ্রহ
মালচিং পদ্ধতিতে মরিচ চাষের ফলন সংগ্রহ একটি নিয়ম তান্ত্রিক প্রক্রিয়া। যা সঠিক সময়ও পদ্ধতি অনুসরণ করে করতে হয়।মালচিং পদ্ধতির মাধ্যমে সংস্কৃত মরিচ গাছগুলি সুস্থ থাকে,মাটি আদ্রতা ধরে রাখে এবং রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ থেকে সুরক্ষিত থাকে,ফলে ফলন ভালো হয়। মরিচ গাছ লাগানোর ৬০-৯০ দিনের মধ্যে ফল সংগ্রহের জন্য প্রস্তুত হতে শুরু করে। মরিচ যখন গাড়ো সবুজ বা পাকা লাল রং ধারণ করে তখন তা সংগ্রহের জন্য প্রস্তুত বলে ধরা হয়।
সাধারণত সবুজ মরিচ সংগ্রহের জন্য ৭০-৮০ দিনের প্রয়োজন হয়। আর যদি মরিচ কে লাল হতে দিলে ফলন কমে যাবে। মরিচ ফল পাকার সাথে সাথে প্রতিদিন গাছ পর্যবেক্ষণ করা গুরুত্বপূর্ণ। ফলন পরিপক্ক হলে দ্রুত সংগ্রহ করতে হবে, কারণ অতিরিক্ত পাকার ফলে মরিচ নরম হয়ে যেতে পারে এবং গুণগত মান নষ্ট হতে পারে। হাত দিয়ে ভালোভাবে মরিচ টেনে গাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে, যাতে গাছের শাখা বা মূল কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। মরিচের ফলন সাধারণত প্রতি ৭-১০ দিন পর পর সংগ্রহ করা যায়। কারন মরিচ দীর্ঘদিন ধরে ফলন দেয়।
শেষ কথা
মালচিং পদ্ধতিতে মরিচ চাষের মাধ্যমে বাংলাদেশের কৃষকদের সুবিধার খোলার সম্ভাবনা রয়েছে। এটি একটি আধুনিক ও পরিবেশ বান্ধব পদ্ধতি,যা মাটির আদ্রতা ধরে রাখে, পোকামাকড় ও আগাছা নিয়ন্ত্রণ করা এবং ফলনের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে সহায়ক। বাংলাদেশের আবহাওয়া এবং মাটির পদ্ধতির জন্য বিশেষভাবে উপযোগী যেনো মরিচ চাষ করে আরো লাভ জনক করে তুলতে পারে।
মালচিং পদ্ধতিতে মরিচ চাষের ফলে কৃষকের খরচ কমে যায়, ফলনের গুণগত মান বৃদ্ধি পায় এবং পরিবেশ সংরক্ষণ সহায়ক হয়। বাংলাদেশে মালচিং পদ্ধতিতে ব্যবহার করে মরিচ চাষ করলে কৃষকরা সহজেই উচ্চমানের লাভজনক ফসল উৎপাদন করতে পারবেন।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url